― Advertisement ―

spot_img

বাংলার ইতিহাস (১৯০৫-১৯৪৭) পরীক্ষা-২০১৭

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় (ইতিহাস বিভাগ) বিষয় কোড : 241503 বিষয় : বাংলার ইতিহাস (১৯০৫-১৯৪৭) ক-বিভাগ (ক) ক্ষুদিরাম কে ছিলেন? উত্তর : ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম দিকের সর্বকনিষ্ট এক বিপ্লবী ছিলেন। (খ) কখন...
Homeবাংলার ইতিহাস১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের কারণ কি ছিল? এতে হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া কি ছিল?

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের কারণ কি ছিল? এতে হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া কি ছিল?

অথবা, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কেন হয়েছিল? এর কর পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া আলোচনা কর।


ভূমিকা : ব্রিটিশ ভারত ও বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ একটি অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ১৯০৫ সালে ভারতের যে তৎকালীন বড়লাট লর্ড জর্জ নাথানিয়েল কার্জন বাংলা প্রদেশ অ ভাগ করেন। যা ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত। বঙ্গভঙ্গের ফলে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ ও ‘পূর্ববঙ্গ’ নামে নতুন দুটি প্রদেশ গঠিত হয়। বে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার সমন্বয়ে গঠিত পূর্ববঙ্গের সাথে মালদা পি জেলার চিফ কমিশনার শাসিত আসামের সঙ্গে সংযুক্ত করে পূর্ব সর বাংলা ও আসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করা হয়। যেটি ইতিহাসে ‘বঙ্গ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। বঙ্গভঙ্গ ও এর রাজ ” পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাবলি ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। বঙ্গভঙ্গ ও রদকে কেন্দ্র করে বাংলার প্রধান দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানের দীর্ঘদিনের গড়ে ওঠা ঐক্যের বিপরীতে অনৈক্যের সূত্রপাত ঘটে।

→ বঙ্গভঙ্গ : ১৮৯৮ সালে লর্ড কার্জন ভারতের বড়লাট হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করেন। লর্ড কার্জনের শাসনকালের মধ্যে শাঁ সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ সংস্কার হলো বঙ্গভঙ্গ। তৎকালে সমগ্র এ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, মধ্য প্রদেশ ও আসামের কিছু অংশ নিয়ে ছিল বঙ্গ প্রদেশ বা বাংলা প্রেসিডেন্সি। প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য লর্ড কার্জন ১৯০৩ সালে এই বিরাট প্রদেশকে দুইভাগে বৃদ্ধি ভাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি উত্তর ও পূর্ব বাংলাকে সর আসামের সাথে সংযুক্ত করে একটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করেন। দ্বিধ এই নবগঠিত প্রদেশের নামকরণ করেন পূর্ব বাংলা ও আসাম। অপরদিকে পশ্চিম বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সমন্বয়ে আরেকটি  ব প্রদেশ গঠিত হয়। যার নাম দেওয়া হয় ‘বাংলা প্রদেশ’ (Bangla Po Presidency). ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর থেকে বঙ্গভঙ্গ আইন কার্যকর হয় ।   বঙ্গভঙ্গের কারণ : বঙ্গভঙ্গের কারণ বিশ্লেষক ঐতিহাসিকরা দুটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।কর্তাব্যক্তিরা বঙ্গভঙ্গের প্রধান কারণ হিসেবে প্রশাসনিক কারণকে  উল্লেখ করলেও এর পিছনে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণও বিদ্যমান । নিচে বঙ্গভঙ্গের কারণগুলো আলোচনা করা হলো : ১. প্রশাসনিক কারণ : ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গের উদ্যোগনেয়ার পিছনে প্রশাসনিক কারণ হলো :

(ক) বাংলা প্রদেশের আয়তনের বিশালতা : ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ মনে করেন যে, বাংলা একটি বিশাল প্রদেশ। বিভক্তির | বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, মধ্য প্রদেশ ও আসামের কিছু অংশ নিয়ে বাংলা প্রদেশ ছিল। এটি ছিল আয়তন ও জনসংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় প্রদেশ। এর আয়তন ছিল ১ লক্ষ ৮৯ হাজার . বর্গমাইল এবং ১৯০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এর জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৫০ লক্ষ

একজন গভর্নরের পক্ষে এত বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনা করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এজন্য প্রশাসনিক সুবিধার কথা বিবেচনা করে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ করা হয়।

(খ) বঙ্গ প্রদেশে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা : পূর্ব বাংলার যোগাযোগ, পুলিশ ও ডাক ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে দক্ষিণ

ও পূর্ব বাংলার বিস্তীর্ণ চর ও হাওড়ে প্রতিনিয়ত চুরি, ডাকাতি ও বেআইনি কর্মকাণ্ড হতে থাকে। বাংলাকে এসব অরাজক [ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

২. রাজনৈতিক কারণ : বেশির ভাগ ভারতীয় ঐতিহাসিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে বঙ্গভঙ্গের প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বঙ্গভঙ্গের পিছনে যেসব রাজনৈতিক কারণ বিদ্যমান ছিল তা হলো :

(ক) বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা ধ্বংস করা : কলকাতা

কেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্ত ভিত গড়ে উঠে। বিশেষ

করে ১৮৮৫ সালে ভারতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর থেকে তা আরো  সুদৃঢ় হতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার মনে করে জাতীয়তাবাদী এ শক্তিকে নস্যাৎ করে দিতে পারলে বাঙালির শক্তি ক্ষীণ হয়ে যাবে। এই ভেবে সরকার বঙ্গভঙ্গের উদ্যোগ গ্রহণ করেন ।

(খ) কংগ্রেসকে দুর্বল করা : ১৮৮৫ সালে ভারতীয় কংগ্রেস ✉ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভারতবাসীর মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা  বৃদ্ধি পেয়েছে। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক সচেতনতা ব্রিটিশ ক সরকারকে সঙ্কিত করে তুলে এবং বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে কংগ্রেসকে

 দ্বিধাবিভক্ত করে এর শক্তি হ্রাস করে।

(গ) বিভক্ত ও শাসননীতি : বঙ্গভঙ্গের অন্যতম কারণ ছিল

ব্রিটিশ সরকারের বিভক্ত ও শাসননীতি’র (Divide and Rule _a Policy) অন্যতম একটি অংশ। ভারতে ব্রিটিশ রাজশক্তিকে  শক্তিশালী করা ও বাঙালিদের শক্তি ক্ষীণ করার জন্য দুই  বাংলাকে বিভক্ত করা নীতি অবলম্বন করা হয়। 

৩. অর্থনৈতিক কারণ : বঙ্গভঙ্গের পিছনে ব্রিটিশ সরকারের অর্থনৈতিক কারণগুলো নিম্নরূপ :

(ক) অর্থনৈতিক বৈষম্য দুরীভূত করা । অবিভক্ত বাংলা বাংলার রাজধানী হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু কলকাতা কেন্দ্রিক হওয়ায় বাংলা প্রদেশ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে পড়ে। এজন্য । বাংলায় অর্থনৈতিক বিকাশ সাধন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও

অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধনের জন্য বঙ্গভঙ্গ করা হয়।

(খ) জমিদারদের অত্যাচার থেকে রায়তদের মুক্তি : কলকাতা কেন্দ্রিক আধুনিক সভ্যতার বিকাশ সাধনের ফলে অধিকাংশ জমিদার কলকাতায় বসবাস করা শুরু করে। অনুপস্থিতিতে তাদের নিযুক্ত নায়েব, গোমস্তারা রায়ত তথা প্রজাদের উপর নানাভাবে অত্যাচার করতো। প্রজাদের উ এমন অত্যাচার থেকে মুক্ত করার জন্য ও তাদের অর্থনৈতিক ব স্বচ্ছলতা আনয়নের জন্য বঙ্গভঙ্গ করা হয়।

৪. সামাজিক ও ধর্মীয় কারণ : ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকে তাদের বৈষম্যমূলক আচরণের ফলে মুসলমানরা ধীরে ধীরে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রাধান্য হারাতে থাকে। তাছাড়া স্মরণাতীতকাল থেকে পূর্ব বাংলায় মুসলমানদের ও পশ্চিম বাংলায় হিন্দুদের প্রাধান্য বিরাজমান ছিল। এজন্য ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয় বিবেচনা করে বঙ্গভঙ্গের জন্য উদ্যোগী হয় ।

→ বঙ্গভঙ্গের ফলে হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া : ১৯০৫ সালের ঘোষিত বঙ্গভঙ্গের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের ১৯০৫ সালের । ঘোষিত বঙ্গভঙ্গের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে বঙ্গভঙ্গের ফলে হিন্দুদের মধ্যে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে য আলোচনা উপস্থাপন করা হলো-

১. মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু ও বর্ণ হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া : ও উচ্চ বর্ণের হিন্দুসম্প্রদায় ১৯০৩ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব  প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই এর বিরোধিতা শুরু করে।  কলকাতা কেন্দ্রিক সকল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চ বর্ণের হিন্দুস। বিশেষ করে জমিদার, রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আইনজীবী ও সাংবাদিক সবাই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়। তারা বঙ্গভঙ্গকে জাতীয় সংহতি ও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি আঘাত বলে অভিহিত করেন। হিন্দু নেতৃবৃন্দ বাঙালি বিরোধী, জাতীয়তাবাদ বিরোধী ও বঙ্গমাতার বিশেষণে আখ্যায়িত করেন। তারা মনে করেন এর দ্বারা মুসলমানদের প্রধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে এজন্য যেকোনো মূল্যে হিন্দু সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গকে রুখে দিতে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন এবং তাদের দাবির মুখে ১৯১১ সালে মাত্র ৬ বছরের মাথায় ব্রটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

২. নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া : উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করলেও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানায়। বাংলায় হিন্দুসম্প্রদায়ের মধ্যে নমশূদ্র ছিল সংখ্যা গরিষ্ঠ। হিন্দু ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও কায়স্থদের ঘৃণার ফলে তারা ছিল অনগ্রসর। বর্ণ হিন্দুদের রাজনৈতিক অভিলাষের মধ্যে তারা কোনো স্বার্থ খুঁজে পায়নি। তাই তারা বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করে।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, লর্ড কার্জন কর্তৃক ঘোষিত বঙ্গভঙ্গ যেমন মুসলমান সম্প্রদায়কে আনন্দিত করে ঠিক তেমনিভাবে হিন্দু সম্প্রদায়কে ব্যাথিত করে তোলে। কারণ বঙ্গভঙ্গের ফলে রাজধানী হিসেবে কলকাতার গুরুত্ব কমে যায় এবং হিন্দুরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পরে। অপরদিকে মুসলমানরা আর্থিক স্বচ্ছলতাসহ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠে। নিজেদের দাবি ও অধিকার সংরক্ষণের জন্য সোচ্চার হয় । বঙ্গভঙ্গ ও এর রদ বাঙালির মধ্যে মুসলিম জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায় এবং স্বতন্ত্র জাতিস্বত্তা হিসেবে বাঙালি মুসলমানদের আত্মপ্রকাশে বঙ্গভঙ্গ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।